ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যা নগরবাসীর জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার কারণ:
- অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাশয় ভরাট:
- ঢাকার জলাশয়, খাল, এবং নিম্নাঞ্চল ব্যাপকভাবে ভরাট হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ৯ বছরে ঢাকায় ৩,৪৮৩ একর জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট হয়েছে, যা ২০১০ সালের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) লঙ্ঘন করে। এর ফলে বৃষ্টির পানি শোষণের জন্য উন্মুক্ত জায়গা কমে গেছে।
- ১৯২৪ সালে পুরান ঢাকায় ১২০টি পুকুর ছিল, বর্তমানে মাত্র ২০টি টিকে আছে। খালের সংখ্যাও কমে ২২টিতে এসেছে, যা সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে।
- অবৈধ দখল ও খাল-নালার সংকোচন:
- ঢাকার খালগুলো অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে, যা পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ বন্ধ করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা নদী দূষণ ও দখলের কারণে নাব্যতা হারিয়েছে।
- নালা-নর্দমায় ময়লা-আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক, এবং কঠিন বর্জ্য নালার মুখ বন্ধ করে দেয়।
- অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা:
- ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সাতটি সংস্থার (যেমন, ঢাকা ওয়াসা, ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, রাজউক) অধীনে পরিচালিত হয়, কিন্তু এদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
- ঢাকা ওয়াসার ৮০% যন্ত্রপাতি এবং ৫৫টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৩৭টি বিকল। ড্রেনেজ লাইনগুলোও অকার্যকর, ফলে পানি নদীতে পৌঁছাতে পারে না।
- শহরের পশ্চিমাঞ্চলে গোড়ানচাটবাড়ি ও কল্যাণপুর পাম্পস্টেশন পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ, কিন্তু এদের সামনের জলাধার সংকুচিত হওয়ায় পানি জমে থাকে।
- অপরিকল্পিত নির্মাণ ও অসমতল ভূমি:
- ঢাকার নগর পরিকল্পনা শুরু থেকেই অসমতলভাবে গড়ে উঠেছে। উঁচু এলাকার পানি নিচু এলাকায় গড়িয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ড্রেন নির্মাণে তলদেশ সমতল না করায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে না।
- শহরে উন্মুক্ত জায়গা মাত্র ১৮%, যেখানে একটি আদর্শ শহরে ৪০% উন্মুক্ত জায়গা প্রয়োজন। মূল শহরে এটি ১০% এরও কম।
- জনসচেতনতার অভাব:
- নাগরিকরা ঘরের ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় বা নালায় ফেলে, যা পানির প্রবাহ বন্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ, পলিথিন ব্যাগ ও কঠিন বর্জ্য নালায় জমে।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি সচেতনতার অভাবে নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখা যায় না।
- জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিবৃষ্টি:
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে জুন মাসে ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যা সাধারণত ৪০ মিলিমিটারের নিচে থাকলে জলাবদ্ধতা হয় না।
- বর্ষাকালে (মে-অক্টোবর) পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়ে।
- শিল্প ও যানবাহনের দূষণ:
- শিল্পকারখানার বর্জ্য, ইটভাটার ধোঁয়া, এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া নদী ও খালে দূষণ বাড়ায়। বুড়িগঙ্গা নদী এখন সম্পূর্ণ দূষিত।
জলাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের উপায়:
- খাল-নালা ও জলাশয় দখলমুক্ত করা:
- অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খাল-নালা ও জলাশয় পুনরুদ্ধার করতে হবে। ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ প্যারিস ক্যানালের মতো ভরাট খাল পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ১০০ কিলোমিটার খাল পরিষ্কারে ১০ কোটি টাকারও কম খরচ হয়েছে, যা আগে ১০০ কোটি টাকার বেশি ছিল।
- জলাশয় রক্ষায় আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী বা বিশেষ টাস্কফোর্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন:
- ঢাকা ওয়াসার বিকল যন্ত্রপাতি মেরামত ও স্লুইসগেট সচল করতে হবে। নতুন ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি এবং পুরনো ড্রেন সমতল করে নির্মাণ করতে হবে।
- পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পাম্পস্টেশন স্থাপন এবং তাদের সামনের জলাধার প্রশস্ত করতে হবে।
- নালায় বর্জ্য ট্র্যাপ বা ছাঁকনি স্থাপন করতে হবে, যাতে পলিথিন ও কঠিন বর্জ্য প্রবেশ করতে না পারে।
- সবুজায়ন ও উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধি:
- শহরে ৪০% উন্মুক্ত জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। মাটি ও গাছপালা বৃষ্টির পানি শোষণ করতে পারে, তাই সবুজায়ন বাড়াতে হবে। মোহাম্মদ এজাজ মিরপুর পল্লবীতে কৃষ্ণচূড়া ও সোনালু গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
- রুফটপ গার্ডেনের জন্য ৫% ট্যাক্স ছাড়ের উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
- নাগরিকদের ময়লা-আবর্জনা নালায় না ফেলার জন্য সচেতন করতে হবে। জনসচেতনতা ক্যাম্পেইন, স্কুলে শিক্ষা, এবং মিডিয়ার মাধ্যমে এটি করা যায়।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
- সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়:
- ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, এবং অন্যান্য সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ তৈরি করে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তদারকি করা যেতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদি ও প্রযুক্তিগত সমাধান:
- স্পঞ্জ সিটি মডেল: চীনের স্পঞ্জ সিটি ধারণা গ্রহণ করা যেতে পারে, যেখানে শহরের পানি শোষণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এতে পারমেবল পেভমেন্ট, রেইন গার্ডেন, এবং জলাশয় পুনরুদ্ধার জড়িত।
- স্বল্প, মধ্য, এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, হাতিরঝিল প্রকল্প কিছুটা সফল হলেও এর প্রভাব সীমিত। নতুন প্রকল্পে জলাশয় সংরক্ষণ ও খাল পুনরুদ্ধারে জোর দিতে হবে।
- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা:
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি মোকাবিলায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। মোহাম্মদ এজাজ প্যারিসে “পার্টনারশিপ ফর হেলথি সিটি সামিট”-এ ঋণের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অনুদানের আহ্বান জানিয়েছেন, যা জলবায়ু প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাল-জলাশয়ের দখল, এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। মোহাম্মদ এজাজের উদ্যোগ (যেমন, খাল পরিষ্কার, সবুজায়ন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ) ইতিবাচক হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং প্রযুক্তিগত সমাধান (যেমন, স্পঞ্জ সিটি) প্রয়োজন। জনসচেতনতা ও নাগরিক সহযোগিতাও অপরিহার্য।