বাংলাদেশ ও বিশ্ব

 

বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও আন্তর্জাতিক আইন: বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকলেও, এসব নদীর পানি বণ্টনে ন্যায্যতা ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে ফারাক্কা ব্যারাজতিস্তা ব্যারাজ নিয়ে বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী ও স্পর্শকাতর।


🔹 প্রধান সমস্যাসমূহ:

  1. একতরফা পানি প্রত্যাহার:

    • গঙ্গা নদীর উজানে ভারত প্রায় ৩৬টি ব্যারাজ ও বাঁধ নির্মাণ করেছে।

    • ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হয় ১৯৭৫ সালে মাত্র ৪১ দিনের একটি অস্থায়ী চুক্তির অধীনে, কিন্তু তা কখনো বন্ধ হয়নি।

  2. তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি:

    • ২০১১ সালের খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ৩৭.৫% ও ভারতকে ৪২.৫% পানি দেওয়ার কথা থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তিতে চুক্তি হয়নি।

    • ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ থেকে একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ব্যারাজ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

  3. চুক্তির ঘাটতি ও দুর্বলতা:

    • ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিতে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ না থাকায় ভারত চাইলেই কম পানি দিতে পারে।

    • দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গড়াই-মধুমতী নদী ও অন্যান্য নদীতে লবণাক্ততা বেড়েছে এবং নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে।


🔹 আন্তর্জাতিক আইন ও বাংলাদেশের অবস্থান:

🏛 জাতিসংঘ কনভেনশন (1997):

  • নাম: Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses

  • ধারা অনুযায়ী যা উল্লেখযোগ্য:

    1. ধারা ৫-৬: পানি ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যবহার করতে হবে।

    2. ধারা ৭: অন্য দেশের ক্ষতি না করার বাধ্যবাধকতা।

    3. ধারা ৯: তথ্য বিনিময়ের বাধ্যবাধকতা।

    4. ধারা ১১-১৯: স্থাপনা নির্মাণের আগে অববাহিকার দেশগুলোকে জানাতে হবে।

    5. ধারা ২০-২৩: প্রতিবেশ রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ।

    6. ধারা ২৭-২৮: জরুরি পরিস্থিতিতে সতর্কতা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা।

    7. ধারা ৩২: বৈষম্য করা যাবে না

❗ সমস্যা:

  • বাংলাদেশ ও ভারত এই কনভেনশনে এখনো স্বাক্ষর করেনি

  • আন্তর্জাতিক কোনো আলোচনায় গেলে প্রশ্ন ওঠে: “আপনি কী এই আইনে স্বাক্ষর করেছেন?”


🔹 তুলনামূলক উদাহরণ:

  • ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু নদী চুক্তি (১৯৬২) বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় করেছে এবং তা যথাযথভাবে মেনে চলছে।

  • অথচ বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ভারত চায় না।


🔹 পরামর্শযোগ্য উদ্যোগ:

  1. বাংলাদেশের উচিত ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা, যাতে আন্তর্জাতিক ফোরামে আইনি ভিত্তি জোরদার হয়।

  2. বহুপাক্ষিক ফোরামে (যেমন: জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক) পানির ন্যায্য ভাগ চাওয়ার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা।

  3. আঞ্চলিক জোটে (যেমন: সার্ক) পানির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো উচিত।

  4. তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার সম্ভাবনা (বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা) বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

  5. তথ্য-উপাত্ত, স্যাটেলাইট ছবি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে ভারতের কার্যকলাপের প্রভাব তুলে ধরা।

***********************************

মানবিক করিডোর হলো সংঘাত বা দুর্যোগের সময় মানবিক সাহায্য পৌঁছানো বা নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি অস্থায়ী নিরাপদ পথ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের মাধ্যমে এমন একটি করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব উঠেছে।

মানবিক করিডোর কী?

মানবিক করিডোর হলো একটি অস্থায়ী নিরাপদ পথ বা অঞ্চল, যা সংঘাত বা দুর্যোগের সময় মানবিক সাহায্য পৌঁছানো বা নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য স্থাপিত হয়। এটি সাধারণত জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যস্থতায় সংঘাতের দলগুলোর সম্মতির মাধ্যমে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডোর সাহায্য পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
  • ২০২২ সালে ইউক্রেনে নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য করিডোর স্থাপন করা হয়।

মানবিক করিডোরের উদ্দেশ্য হলো সংঘাতে আটকে পড়া মানুষদের জন্য নিরাপত্তা ও সাহায্য নিশ্চিত করা।

রাখাইনের সংকট ও বাংলাদেশের ভূমিকা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক শাসন ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘাত মানবিক সংকটকে তীব্র করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে ৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং ২০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য সাহায্যের জন্য জরুরি অবস্থায় রয়েছে (OHCHR). মিয়ানমারের সামরিক শাসন সাহায্য ও বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।

বাংলাদেশ, যেখানে ২০১৭ সালের সামরিক অভিযানের পর থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে, এই সংকটের সরাসরি প্রভাবের মুখে রয়েছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এই শরণার্থীরা বসবাস করছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোরের প্রস্তাব

জাতিসংঘ এবং ফোর্টিফাই রাইটসের মতো সংস্থা বাংলাদেশের মাধ্যমে রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই করিডোরের লক্ষ্য হলো রাখাইনের মানুষদের জন্য জীবনরক্ষাকারী সাহায্য পৌঁছানো এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য পরিস্থিতি উন্নত করা।

২০২৫ সালের মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরকালে এই করিডোরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, এটি স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের সকল পক্ষের সম্মতি ও সহযোগিতা প্রয়োজন (BenarNews). ফোর্টিফাই রাইটসও এই করিডোরকে সকল সম্প্রদায়ের জন্য জীবনরক্ষাকারী হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে (Fortify Rights).

বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক প্রভাব

ইতিবাচক প্রভাব

বিবরণ

মানবিক সহায়তা প্রদান করিডোরের মাধ্যমে রাখাইনে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের মানবিক ভূমিকাকে শক্তিশালী করবে।
শরণার্থী প্রত্যাবর্তন রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফিরলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম হতে পারে, যা বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার চাপ কমাবে।
আন্তর্জাতিক সম্মান এই উদ্যোগে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইমেজ উন্নত করতে পারে এবং সহায়তা পাওয়ার সুযোগ বাড়াতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব

নেতিবাচক প্রভাব বিবরণ
নিরাপত্তার ঝুঁকি করিডোর সশস্ত্র গোষ্ঠী বা অপরাধীদের দ্বারা শোষিত হতে পারে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
সংস্থানের চাপ করিডোর পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের সংস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।
রাজনৈতিক জটিলতা মিয়ানমারের সামরিক শাসন বা আরাকান আর্মির সাথে সমন্বয় করা কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

বর্তমান অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ তোহিদ হোসেন জানিয়েছেন, সরকার শর্তসাপেক্ষে মানবিক করিডোরের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। তবে, এটি জাতিসংঘের স্থানীয় অফিসের কার্যনির্বাহী বিষয় বলে তিনি উল্লেখ করেছেন (Dhaka Tribune). বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতা মুহাম্মদ ইউনুস আরাকান আর্মির সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের জন্য “নিরাপদ অঞ্চল” নিয়ে আলোচনা করছেন, তবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে, যা নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি করে (Fortify Rights).

জাতিসংঘ রাখাইনে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছে এবং তহবিল সংকটের কারণে ২০২৫ সালে খাদ্য রেশন ৪০% কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে (BenarNews). ফোর্টিফাই রাইটস জানিয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক শাসনের সাহায্য নিষেধাজ্ঞা সরাসরি নাগরিক মৃত্যুর কারণ হয়েছে, যেমন ২০২৪ সালে একটি ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাবে ১২ জনের মৃত্যু (ReliefWeb).

উপসংহার

রাখাইনের জন্য একটি মানবিক করিডোর বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই নিয়ে আসতে পারে। এটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের পথ সুগম করতে পারে, তবে নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং সংস্থানের চাপ এর বাস্তবায়নকে জটিল করে তুলতে পারে। বাংলাদেশকে এই প্রস্তাব গ্রহণের আগে সাবধানে সকল দিক বিবেচনা করতে হবে এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। এই করিডোরের সাফল্য নির্ভর করবে মিয়ানমারের সকল পক্ষের সহযোগিতার উপর।

আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহ

BRICS কি উগ্র পুঁজিবাদকে পরাস্ত করতে পারবে?

🔑 প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট:

  • BRICS: Brazil, Russia, India, China, South Africa।

  • সম্প্রসারিত হচ্ছে — আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব, UAE যুক্ত হচ্ছে।

Continue reading