ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় সমস্যা। এই শত্রুতা ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু হয়ে কাশ্মীর বিরোধ, সন্ত্রাসবাদ এবং রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে টিকে আছে।
ভারত-পাকিস্তান শত্রুতার উৎস
ভারত-পাকিস্তান শত্রুতার শিকড় ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ ভারতের দেশভাগে। ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তির পর, ভারত ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশে বিভক্ত হয়: হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান। এই বিভাজনের সময়, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেও, রাজ্যের হিন্দু শাসক মহারাজা হরি সিংহ প্রথমে স্বাধীন থাকতে চান। তবে, পাকিস্তানি উপজাতিদের আক্রমণের পর তিনি ভারতের সঙ্গে যোগ দেন, যা ১৯৪৭-৪৮ সালে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা করে (India-Pakistan Partition | Origins).
দেশভাগের সময় ১-২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং ২ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এই সহিংসতা দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস তৈরি করে। কাশ্মীর বিরোধ এই শত্রুতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, যা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এবং ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের মতো সংঘাতের কারণ হয় (Indo-Pakistani wars and conflicts – Wikipedia). এছাড়াও, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীন হওয়ার সময় ভারতের ভূমিকা পাকিস্তানের কাছে আরও ক্ষোভের কারণ হয়।
কেন এই শত্রুতা টিকে আছে?
ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা টিকে থাকার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে:
কাশ্মীর বিরোধ
কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ এই শত্রুতার প্রধান কারণ। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরের ওপর দাবি করে, এবং এই অঞ্চলে সীমান্ত সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে (Kashmir: Why India and Pakistan fight over it – BBC News).
রাজনৈতিক স্বার্থ
দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শত্রুতাকে ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো পাকিস্তানবিরোধী অবস্থানকে জনপ্রিয়তার জন্য ব্যবহার করে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং রাজনীতিবিদরা কাশ্মীর ইস্যুকে জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে।
সন্ত্রাসবাদ এবং অবিশ্বাস
পাকিস্তানের মাটিতে সক্রিয় সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, যেমন লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদ, ভারতে হামলা চালিয়েছে, যেমন ২০০১ সালের ভারতীয় সংসদ হামলা এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা। ভারতের দাবি, পাকিস্তান এই গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে, যা পাকিস্তান অস্বীকার করে। এই অভিযোগ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথে বড় বাধা (History of Conflict in India and Pakistan – Center for Arms Control and Non-Proliferation).
আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মতো পরাশক্তি এই শত্রুতাকে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, চীন পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে বিনিয়োগ করে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। অন্যদিকে, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে (India–Pakistan relations – Wikipedia).
দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ব্যর্থতা
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির জন্য বহু দ্বিপাক্ষিক আলোচনার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু প্রচেষ্টা হলো:
- সিমলা চুক্তি (১৯৭২): ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এই চুক্তি দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
- লাহোর ঘোষণা (১৯৯৯): ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর পাকিস্তান সফরের পর এই ঘোষণা শান্তির আশা জাগায়, কিন্তু কার্গিল যুদ্ধ এটিকে ভেস্তে দেয়।
- আগ্রা শীর্ষ সম্মেলন (২০০১): এই সম্মেলন সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ব্যর্থ হয়।
এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো অবিশ্বাস। ভারতের দাবি, পাকিস্তানকে প্রথমে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে হবে, যা পাকিস্তান মানতে নারাজ। পাকিস্তান আবার কাশ্মীরে ভারতের সামরিক উপস্থিতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। এই পারস্পরিক অভিযোগ আলোচনাকে অচল করে রেখেছে (A History of the Conflict between India and Pakistan with Intervention from the United Nations).
বর্তমান প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালেও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা এবং সীমান্ত উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে পাহালগামে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হয়, যার মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় পর্যটক ছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে এবং দুই পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে, যা পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। এই ঘটনার পর ভারত ইন্দাস জল চুক্তি স্থগিত করেছে এবং সীমান্তে সামরিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে (What to Know About India and Pakistan’s Escalating Tensions in Kashmir | TIME).
তথ্যসূত্র এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ
নিচের তালিকায় ভারত-পাকিস্তান শত্রুতার কিছু মূল ঘটনা এবং তাদের প্রভাব দেখানো হলো:
ঘটনা |
বছর |
বিবরণ |
প্রভাব |
---|---|---|---|
দেশভাগ | ১৯৪৭ | ব্রিটিশ ভারত ভারত এবং পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। | ১-২ কোটি বাস্তুচ্যুত, ২ লাখ-২০ লাখ মৃত্যু, কাশ্মীর বিরোধের সূচনা। |
প্রথম যুদ্ধ | ১৯৪৭-৪৮ | কাশ্মীরে পাকিস্তানি উপজাতিদের আক্রমণ, ভারতের হস্তক্ষেপ। | কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত, নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠিত। |
দ্বিতীয় যুদ্ধ | ১৯৬৫ | কাশ্মীর নিয়ে সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে পূর্ণ যুদ্ধ। | কোনো পক্ষের সুস্পষ্ট জয় না হওয়া, তাশখন্দ চুক্তি। |
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ | ১৯৭১ | ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীন হয়। | পাকিস্তানের পরাজয়, অবিশ্বাস বৃদ্ধি। |
কার্গিল যুদ্ধ | ১৯৯৯ | পাকিস্তানি সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে। | ভারতের বিজয়, আলোচনার পথে বাধা। |
মවිশেষ হামলা | ২০০১, ২০০৮ | ভারতীয় সংসদ এবং মুম্বাই হামলা। | আলোচনা ভেস্তে যায়, অবিশ্বাস বৃদ্ধি। |
আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল | ২০১৯ | জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল। | পাকিস্তানের তীব্র প্রতিক্রিয়া, উত্তেজনা বৃদ্ধি। |
পাহালগাম হামলা | ২০২৫ | ২৬ জন নিহত, ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। | সীমান্তে সংঘর্ষ বৃদ্ধি, ইন্দাস জল চুক্তি স্থগিত। |
উপসংহার
ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা একটি জটিল সমস্যা, যার শিকড় ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক। কাশ্মীর বিরোধ, সন্ত্রাসবাদ এবং রাজনৈতিক স্বার্থ এই শত্রুতাকে টিকিয়ে রেখেছে। দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক অভিযোগের কারণে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। শান্তির জন্য সন্ত্রাসবাদ বন্ধ, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা প্রয়োজন। তবে, উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই শত্রুতার সমাধান কঠিন।