সাজেক ভ্রমণ: মেঘ, পাহাড় আর এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা

নিজের দেশকে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ভ্রমণ। বইয়ের পাতা কিংবা ইন্টারনেট থেকে জেনে নেওয়া সম্ভব হলেও, বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের মজাই আলাদা। ভ্রমণ আমাদের শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যই উপভোগ করতে সাহায্য করে না, বরং আমাদের জীবনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শেখায়। মোবাইল ফোন ও প্রযুক্তির আসক্তি থেকে বের হয়ে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়াটাই হতে পারে মানসিক প্রশান্তির সবচেয়ে ভালো উপায়।

আজ আমি শেয়ার করব আমার স্বপ্নের গন্তব্য সাজেক ভ্যালি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

সাজেক উপত্যকা

সবুজ পাহাড় আর মেঘের সমারোহে মোড়ানো এই জায়গাটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র।

আমার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল সাজেক উপত্যকা ঘুরে দেখার। মেঘের রাজ্য, পাহাড়ের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রাস্তা আর অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা এতদিন শুধু শুনেছি আর দেখেছি ছবিতে। অবশেষে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো!


আমার সাজেক ভ্রমণের সূচনা

আমার যাত্রা শুরু হলো রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম। প্রথমে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে পৌঁছালাম এবং পাহাড়তলীতে বন্ধুর হলে এক রাত কাটালাম। পরদিন সকালেই আমরা চারজন বন্ধু রওনা দিলাম চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড়ের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে শান্তি পরিবহন ও অন্যান্য বাসে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়।

আমরা সকাল ৬:৩০-এর বাস ধরলাম, কারণ সকালে গেলে সময়ের সাশ্রয় হয় এবং সাজেক ভ্রমণ আরামদায়ক হয়। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে খাগড়াছড়ি শহর পৌঁছালাম। এরপর সাজেক যাওয়ার জন্য জিপ/চান্দের গাড়ি বা সিএনজি ভাড়া নিতে হয়। আমরা চারজন থাকায় একটি সিএনজি ভাড়া করলাম ৬০০০ টাকায় (রিটার্ন ট্রিপসহ)।


অ্যাডভেঞ্চার শুরু: আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ

সিএনজিতে উঠে আমরা দিঘীনালা আর্মি ক্যাম্পের দিকে রওনা দিলাম। এখানে আমাদের নাম এন্ট্রি করতে হলো, কারণ সাজেক যাওয়ার রাস্তা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে নিরাপত্তার স্বার্থে। এরপর শুরু হলো মূল অ্যাডভেঞ্চার!

পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য

পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য এতই মনোমুগ্ধকর যে, মনে হচ্ছিল যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করছি। দুই পাশের উঁচু-নিচু পাহাড়, তার ফাঁকে ফাঁকে ঝিরিঝিরি ঝর্ণা, আর মেঘের দল যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এক পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছিল, আর অন্য পাহাড় একেবারে শুকনো! এই দৃশ্য সত্যিই অবিশ্বাস্য!

সাজেকের মূল পাহাড়ের তিন কিলোমিটার পথ অনেক খাড়া। আমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে বিশ্রাম নিলো, আর আমরা সেই সুযোগে পাহাড়ি লেবু আর মিষ্টি পেঁপে খেয়ে নিলাম।


স্বপ্নের সাজেক: মেঘের রাজ্যে প্রবেশ

অবশেষে আমরা সাজেক পৌঁছে গেলাম! ঢুকতেই যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করলাম—চারপাশে ঘন মেঘ, ঠান্ডা হাওয়া আর পাহাড়ের চূড়ায় রিসোর্টের সারি। এতদিন সাজেকের ছবি দেখেছি, কিন্তু বাস্তবে তা আরও অসাধারণ!

আমরা সিএনজিতে ব্যাগ রেখেই সাজেক হেলিপ্যাডে গেলাম। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক ভিড় জমায়। গোধূলির সময় সূর্য যখন ধীরে ধীরে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিল, লালচে আলো পাহাড়ের গায়ে পড়ছিল—সত্যিই সে দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না!

রাতে আমরা একটি রিসোর্ট বুক করলাম। সাজেকে থাকার খরচ একটু বেশি, কারণ এখানকার প্রায় সব কিছু সমতল এলাকা থেকে আনা হয়। বাঁশের তৈরি রিসোর্টে থাকার অভিজ্ঞতা সত্যিই অন্যরকম! মেঝে দিয়ে হাঁটার সময় কাঠের কটকট শব্দ আসছিল, যা জায়গাটাকে আরও মজাদার করে তুলেছিল।

রাতে আমরা সাজেকের বিশেষ খাবার ব্যাম্বো বিরিয়ানি খেলাম। বাঁশের মধ্যে রান্না করা এই বিরিয়ানি সত্যিই অন্যরকম স্বাদের!


সাজেকে সূর্যোদয় দেখা এবং কংলাক পাহাড় অভিযান

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে যা দেখলাম, তা ছিল জীবনের সেরা মুহূর্ত! সামনে বিশাল মেঘের সমুদ্র, মনে হচ্ছিল যেন আমরা কোনো স্বর্গীয় রাজ্যে চলে এসেছি। সাদা তুলার মতো মেঘ আমাদের চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

কংলাক পাহাড়

এরপর আমরা গেলাম সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাহাড় দেখতে। প্রায় ১৮০০ ফুট উঁচু এই পাহাড়ে উঠতে বেশ কষ্ট হয়, কিন্তু একবার চূড়ায় উঠলে সব কষ্ট ভুলে যেতে হয়। ওপরে গিয়ে মনে হচ্ছিল যেন মেঘ ছুঁতে পারছি! এই পাহাড়ে থেকে সূর্যোদয় অনেক সুন্দর দেখা যায় এবং অনেক সময় ধরে সূর্য উঠতে থাকে। আমরা চা খেতে খেতেই উপভোগ করলাম এক ঝাঁক মেঘের স্পর্শ। হঠাৎ করে একভেলা মেঘ ছুটে আসলো আমাদের দিকে এই প্রথম মেঘ হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম অনেকটা কুয়াশার মতো কিন্তু অন্যরকম এক অনুভূতি।

এখানে আমরা বিশেষ ধরনের বাঁশের মগে করে চা খেলাম, যা আসলেই এক অনন্য অভিজ্ঞতা!


লুসাই গ্রাম: সাজেকের উপজাতি সংস্কৃতি

এরপর আমরা গেলাম লুসাই গ্রাম, যেখানে লুসাই সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। এখানে ১০০ টাকার বিনিময়ে লুসাই পোশাক ভাড়া নিয়ে ছবি তোলা যায়।

সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল দোকানদারবিহীন দোকান! এখানে কোনো বিক্রেতা নেই, শুধু জিনিসপত্র রাখা, আর একটি বাক্সে নির্দিষ্ট দাম লেখা থাকে। পর্যটকেরা জিনিস কিনে টাকা বাক্সে রেখে যান। এমন সততার চর্চা সত্যিই প্রশংসনীয়!


ফেরার পথে খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান

সাজেক থেকে ফেরার পথে আমরা খাগড়াছড়ির কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করি। সাজেকের পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করার পর খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখাটা সত্যিই দারুণ একটা অভিজ্ঞতা ছিল।

খাগড়াছড়ি শহর

আলুটিলা গুহা: অন্ধকারে রহস্যময় অভিযান

আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল আলুটিলা গুহা। এই গুহা নিয়ে আগে থেকেই অনেক গল্প শুনেছিলাম, তাই এক্সপ্লোর করার আগ্রহ ছিল প্রবল। গুহার ভেতর ঢোকার সময় হাতে মশাল নিতে হলো, কারণ সেখানে একেবারে অন্ধকার।

গুহার ভেতর ঢুকেই অনুভব করলাম, জায়গাটা সত্যিই রহস্যময়! ঠান্ডা বাতাস, পিচ্ছিল পাথরের পথ আর মাঝে মাঝে বাদুড়ের ডাক পুরো পরিবেশটাকে আরও বেশি রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল। কিছু জায়গা এত সরু ছিল যে আমাদের হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হয়েছে। প্রায় ৩৫০ ফুট লম্বা গুহার পথ পেরিয়ে আমরা অন্যদিক দিয়ে বের হলাম। এটি সত্যিই ছিল দারুণ একটি অ্যাডভেঞ্চার!

গুহা থেকে বের হওয়ার পর যা দেখলাম, তা ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা দৃশ্য—একসাথে দুইটি রংধনু!

রংধনু

আলুটিলা গুহা থেকে বেরিয়েই দেখি হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে একটা ছাউনির নিচে দাঁড়ালাম। তারপর যা দেখলাম তা আমার জীবনের অন্যতম এক স্মৃতি সামনে তাকিয়ে দেখি পুরো আকাশ জুড়ে রংধনু তার সাত রং নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। একটা রংধনু নয় পাশাপাশি দুইটা এই প্রথম দুইটা রংধনু একসাথে দেখলাম আর এত স্পষ্ট মনে হচ্ছিল এই তো একটু সামনে আমি হাত দিলেই রংধনুর সাত রঙে হাতটি রঙিন হয়ে উঠবে। আলুটিলা গুহার এই জায়গা থেকে খাগড়াছড়ি পুরো শহর দেখা যায়। এইখানে এখন সুন্দর পার্ক করা হয়েছে, বেশ কিছু বসার জায়গা আছে, দোলনা আছে, ছবি তোলার বেশ অনেকগুলো স্পট আছে।

রিছাং ঝরনা: পাহাড়ের কোলে এক মোহনীয় ঝরনা

পরবর্তী গন্তব্য ছিল রিছাং ঝরনা। সাজেকের পথে যারা খাগড়াছড়ির ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য এটি অবশ্যই দেখার মতো একটি জায়গা।

ঝরনার পানি অনেক উঁচু থেকে নিচে পড়ছিল, আর তার শব্দ পুরো জায়গাটাকে আরও মায়াবী করে তুলছিল। আমরা ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করলাম। সেই মুহূর্তটা সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আমরা খাগড়াছড়ি ঘুরে তারপর এই সৌন্দর্যের পরিবেশ থেকে আবারো যান্ত্রিক পরিবেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর আমরা শান্তি পরিবহনে করে অনেকটা মানসিক শান্তি নিয়ে ফিরে এলাম আপন নীড়ে।
আমার অনেক দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো কিন্তু সাজেকের সেই স্মৃতিগুলো কখনো ভুলতে পারিনা। মনে হয় এই যেন আমি মেঘ ছুঁয়ে দেখছি আর চারপাশে আমার অনেকগুলো সবুজ গাছ ছড়িয়ে আছে। সবুজ শ্যামল আমাদের এই বাংলাদেশ সত্যিই অনেক সুন্দর।


সাজেক ভ্রমণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

সাজেক কিভাবে যাবেন?

✔ চট্টগ্রাম/ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বাসে আসতে হবে।
✔ খাগড়াছড়ি শহর থেকে জিপ/চান্দের গাড়ি/সিএনজি ভাড়া করে সাজেক যেতে হবে।
✔ সাজেক যাওয়ার পথে দিঘীনালা আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করতে হবে।

সাজেকে কোথায় থাকবেন?

✔ জনপ্রিয় রিসোর্ট: রুনময় রিসোর্ট, মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট, সিজুক রিসোর্ট
✔ আগে থেকে বুকিং দেওয়া ভালো, কারণ সবসময় রুম পাওয়া যায় না।

সাজেকে কি খাবেন?

ব্যাম্বো বিরিয়ানি
পাহাড়ি লেবু ও মিষ্টি পেঁপে
উপজাতিদের বিশেষ খাবার ও বাঁশের মগের চা


শেষ কথাঃ সাজেক ভ্রমণ স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন!

সাজেক শুধু একটা পর্যটনস্থান নয়, এটি একটি অনুভূতি। এখানে একবার এলে মন চাইবে বারবার ফিরে আসতে। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ভ্রমণ ছিল এটি, যা কখনো ভুলব না!

যদি তোমরা প্রকৃতিপ্রেমী হও, তাহলে সাজেককে অবশ্যই তোমাদের জীবনের অবশ্যই ঘুরতে যাওয়ার তালিকায় (Bucket List) রাখো!

তোমাদের সাজেক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কমেন্টে জানাও!