ভ্রমণ মানেই নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন মানুষ ও নতুন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া। দৈনন্দিন যান্ত্রিক জীবনে যখন ক্লান্তি গ্রাস করে, তখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া মানসিক প্রশান্তির অন্যতম উপায়। আমি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু কাজের চাপে কখনো কখনো জীবন একঘেয়ে মনে হয়। তাই মনে করি, ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া উচিত।
আজ শেয়ার করছি উত্তরবঙ্গের একটি অবিস্মরণীয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর, হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যাব। কাঞ্চনজঙ্ঘা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ, তবে বাংলাদেশ থেকে এটি দেখার সর্বোত্তম স্থান হলো তেতুলিয়া। আমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে আরও কয়েকজন বন্ধু যোগ দিলেন, এবং মোট ১২ জনের দল হয়ে রাজশাহী থেকে তেতুলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
রাজশাহী থেকে পঞ্চগড়ের পথে যাত্রা শুরু
রাত ৯টায় তিতুমীর এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু হলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার রাতের মাঝে চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। বন্ধুদের সাথে গল্প, গান, আর হালকা নাশতার মধ্যে কখন যে সময় কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
সকাল হতে না হতেই পঞ্চগড় স্টেশনে পৌঁছালাম। ঠান্ডা আবহাওয়া আর হালকা কুয়াশার মধ্যে স্টেশনে নেমে মনে হলো, সত্যিই যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি। সেখানে আগে থেকেই বুক করা দুটি অটোতে চেপে আমরা তেতুলিয়ার পথে রওনা হলাম। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি চা বাগান, সরিষার ক্ষেত, আর মাঝে মাঝে আকাশ ছুঁতে চাওয়া বিশাল গাছ আমাদের পুরো পথজুড়েই মুগ্ধ করেছে।
তেতুলিয়া ডাকবাংলো ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন
প্রথম গন্তব্য ছিল তেতুলিয়া ডাকবাংলো, যা এই অঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

তেতুলিয়া ডাকবাংলো
এখান থেকেই পরিষ্কার আকাশ থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের ভাগ্য সহায় ছিল না—সকালবেলার কুয়াশার কারণে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন মিলল না।

কাঞ্চনজঙ্ঘা
তবে হতাশ হওয়ার কিছু ছিল না! ডাকবাংলোর শান্ত পরিবেশ, নদীর ধারে সবুজ গাছপালা, আর উন্মুক্ত প্রান্তর আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছিল। আমরা নদীর ধারে বসে কিছুক্ষণ প্রকৃতির শীতল বাতাস উপভোগ করলাম এবং কিছু সুন্দর ছবি তুললাম।
বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট: ইতিহাস ও সংস্কৃতির মিলনস্থল
এরপর আমরা গেলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, যেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সংযোগস্থলে অবস্থিত মৈত্রী ফলক রয়েছে। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক।

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ফলক
এখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম দুই দেশের মানুষের সীমান্ত পেরিয়ে যাতায়াত, বিজিবি ও বিএসএফ-এর টহল এবং ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তির চিহ্ন। এক কথায়, এটি শুধু একটি সীমান্ত নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট: সবুজের রাজ্য
আমাদের ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট রিসোর্ট। এটি বাংলাদেশের একমাত্র অর্গানিক চা বাগান, যা পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় অবস্থিত।
কেন এটি বিশেষ?
✅ চারপাশ সবুজ চা গাছে ঘেরা
✅ কৃত্রিম লেক ও মনোরম রিসোর্ট
✅ নিঃশব্দ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকা
✅ দেশের একমাত্র অর্গানিক চা উৎপাদন কেন্দ্র

কাজী অ্যান্ড কাজী চা বাগান
আমরা প্রথমে চা বাগানের ভেতর হাঁটাহাঁটি করলাম। চারপাশে সবুজের সমারোহ, পাখির ডাক, আর হালকা কুয়াশার আবরণ সত্যিই এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। রিসোর্টের কাছে পৌঁছানোর পর দেখলাম একটি সুন্দর লেক, যার ওপর কাঠের ব্রিজ বানানো। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট রিসোর্ট
রিসোর্টের কটেজগুলো দেখতে ছিল রাজকীয় ধাঁচের। সেখানকার নিরাপত্তা প্রধান আমাদের স্বাগত জানালেন এবং সৌভাগ্যক্রমে আমরা রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেলাম।
এইখানে কিছু রুম এতটাই নির্জন যে সেখানে গেলে মনে হয় আঠারো শতকের কোনো বাড়িতে এসেছি। জানালা দিয়ে তাকালেই চা বাগানের সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে, যা এক স্বপ্নময় দৃশ্য।

কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট রিসোর্ট
এইখানে যে ধরনের চা বাগান দেখা যায় এইটা শুধুমাত্র এই এলাকাতেই পাওয়া যায়। অনেক গাছের বয়স ১৫-২০ বছর। এই চা বাগানের বিশেষত্ব হলো এইটা সমতলে হয় যেটা আমরা সিলেট বা মৌলভীবাজার অঞ্চলে দেখতে পাই না। চা বাগানের মধ্যে বসে এক কাপ তাজা গরম চা পান করার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ ছিল। এর স্বাদ ছিল সাধারণ চায়ের চেয়ে অনেক আলাদা, কারণ এটি কেমিক্যালমুক্ত ও সম্পূর্ণ অর্গানিক।
ফেরার পথে আনন্দময় স্মৃতি
সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যার দিকে আমরা রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তবে মন পড়ে রইল সেই সবুজ প্রকৃতির মাঝে, নির্মল বাতাসে, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার অদেখা সৌন্দর্যের আশায়।
ফেরার পথে আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে স্মৃতিচারণ করছিলাম—কে সবচেয়ে বেশি ছবি তুলেছে, কে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে, আর কে আবার কবে আসবে সে পরিকল্পনা করছিল।
আপনার তেতুলিয়া ভ্রমণ পরিকল্পনা করুন!
আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমী হন, ইতিহাস পছন্দ করেন, কিংবা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চান, তাহলে তেতুলিয়া আপনার জন্য আদর্শ ভ্রমণ গন্তব্য।
✔ বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুযোগ
✔ তেতুলিয়ার ডাকবাংলোর প্রশান্তিময় পরিবেশ
✔ বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
✔ কাজী অ্যান্ড কাজী চা বাগানের অনন্য অভিজ্ঞতা
আপনি কি কখনো তেতুলিয়া ঘুরতে গিয়েছেন? আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কমেন্টে জানান!