কবিতা

 

 

প্রিয়তমাসু

-সুকান্ত ভট্ট্যাচার্য

সীমান্তে আজ আমি প্রহরী
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে
আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি
স্বদেশের সীমানায়।

ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত নিয়তির মত
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে;
-ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বর্মাতেও।

আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোষাক
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।

আজ কিন্তু নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে আমন্ত্রণ
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি;
কিছুতেই বুঝিনা কী করে এড়াব তাকে,
কী করে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোষাক?
যুদ্ধ শেষ; মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহুর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোষাক
রাত্রে চাঁদ ওঠে, আমার চোখে ঘুম নেই।

তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্র“র পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধ জয়ের ফাঁকে ফাঁকে,
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে,
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায় মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বার বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে।
জানিনা আজো আছো কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কি-না ভিটে,
জানি না তাও।
তবু লিখছি তোমাকে আজ, লিখছি আত্মম্ভর আশায়,
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।

জানি আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক’রে নেই,
মালায় আর পতাকায় প্রদীপে আর মঙ্গল ঘটে
জানি সম্বর্ধনা রটবে না লোকমুখে,
মিলিত খুশীতে মিলবে না বীরত্বের পুরষ্কার।
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে-
সে তোমার হৃদয়।
যুদ্ধ চাইনা আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়।
আর সামনে নয়,
এবার পেছন ফেরার পালা।
পরের জন্য যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ করে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালিতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কন্টক বর্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।

আমি যেন সেই বাতিওয়ালা-
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।

****************************************

তোমার চোখ এত লাল কেন?

নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক।আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেক্ট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।
আমি চাই কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করুক,
আমার জল লাগবে কিনা, নুন লাগবে কিনা।
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না।
এঁটো বাসন গেজ্ঞি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক।কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক, তোমার চোখ এত লাল কেন?

 

****************************************

ছাড়পত্র

-সুকান্ত ভট্টাচার্য

যে শিশু ভুমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।

খর্বদেহ নিঃসহায় তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্ব্যোধ্য প্রতিজ্ঞায়।

সে ভাষা বুঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা।
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর,
অস্পষ্ট কুয়াশা ভরা চোখে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস।

***************************************************************************************************

বৃষ্টি থেমে গেলে ছাতাটাকেও বোঝা মনে হয়।কালি ফুরিয়ে গেলে কলমটাও আবর্জনার ঝুড়িতে জমা হয়। বাসি হয়ে গেলে প্রিয়জনের দেয়া ফুলটাও পরদিন ডাস্টবিনে পাওয়া যায়।

পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য হলো আপনার উপকারের কথা মানুষ বেশিদিন মনে রাখবে না। জীবনের সবচেয়ে নিদারুণ বাস্তবতা হলো, কার কাছে আপনি কতদিন প্রায়োরিটি পাবেন, সেটা নির্ভর করবে কার জন্য কতদিন কিছু একটা করার সামর্থ আছে তার উপর।

এই বাস্তবতা আপনি মানলেও সত্যি, না মানলেও সত্যি। আজ সকালে যে পত্রিকার দাম ১০ টাকা, একদিন পর সেই একই পত্রিকার ১ কেজির দাম ১০ টাকা। হাজার টাকা খরচ করে একাডেমিক লাইফে বছরের শুরুতে যে বইগুলো গুরুত্ব দিয়ে কিনেন, বছর শেষে সেই বইগুলোই কেজি মাপে বিক্রি করে দেন।

সময় ফুরিয়ে গেলে এভাবেই মূল্য কমতে থাকে সবার, সবকিছুর। আমরা আপাদমস্তক স্বার্থপর প্রাণী। ভিখারিকে ২ টাকা দেয়ার আগেও মানুষ চিন্তা করে কতটুকু পূণ্য অর্জন হবে। বিনা স্বার্থে কেউ ভিক্ষুককেও ভিক্ষা দেয় না।

এতকিছুর পরও চলুন একটু হেসে কথা বলি। রাগটাকে কমাই। অহংকারকে কবর দেই।

যদি সুখী হতে চান তবে প্রত্যাশা কমান।

আপনি কারো জন্য কিছু করে থাকলে সেটা চিরতরে ভুলে যান। কারণ সেটা যতদিন আপনি মনে রাখবেন ততদিন সেটা আপনাকে অহংকারী করে তুলবে।

আবার কেউ যদি আপনার জন্য খুব ছোট্ট কিছু একটা করে থাকে,

তবে সেটা আজীবন মনে রাখবেন। কারণ এটা আপনাকে বিনয়ী ও কৃতজ্ঞতাসম্পন্ন একজন ভালো মানুষ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখবে।

******************

আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…
আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…

সঙ্গে সেই স্মৃতি ভার রঙ চটা সেই গীটার।। সেই অহংকার আগুন সেই জোয়ার,
হয় তো সব থাকবে সেই আগেকার মতই পাব কি দেখা রাজশ্রী তোমার……
আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার

হয়তো পথের ধারে পাব বারে বারে আমার শৈশব কৈশোর অমলিন ।।
পাব মায়ের আঁচল প্রিয়া বধূর কাজল অগভীর ধানসিঁড়ির দিন… প্রতিদিন…
থাকবে একলা চলা নয় তো সঙ্গে বলা থাকবে হাজার পাগলামী আমার…
হয় তো সব থাকবে সেই আগেকার মতই পাব কি দেখা রাজশ্রী তোমার……

আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…

হয় তো সন্ধ্যা এসে প্রকৃতির আদেশে নিথর কৃষ্ণ নীল রঙ ছড়াবে ।।
ঘর ভোলা এক পাখি থামিয়ে ডাকাডাকি হঠাৎ স্তব্ধতার গান শোনাবে…
ফিরব সেই পথে আবার সঙ্গে সাত সাগর বাধার ।। সঙ্গে সেই স্থির মন ঢেউ গোনার…
হয়ত সব থাকবে সেই আগেকার মতই, পাব কি দেখা রাজশ্রী তোমার…
আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…
আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…

সঙ্গে সেই স্মৃতি ভার রঙ চটা সেই গীটার ।। সেই অহংকার আগুন সেই জোয়ার,
হয় তো সব থাকবে সেই আগেকার মতই পাব কি দেখা রাজশ্রী তোমার……
আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…
আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে এই পথেই যদি আসি আবার…

– নচিকেতা চক্রবর্তী

*********************************

বনলতা সেন

জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশােকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়ােজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখােমুখি বসিবার বনলতা সেন।