বাংলাদেশে বিহারীদের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা ও গণহত্যা

বিহারী কারা?

বিহারীরা মূলত অবিভক্ত ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা রাজ্য থেকে আসা উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী, যারা ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বসবাস শুরু করেন। তারা মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত এবং ভারত থেকে পাকিস্তানে অভিবাসিত হন পাকিস্তানকে তাদের ধর্মীয় মাতৃভূমি হিসেবে গ্রহণ করার কারণে।

তারা কবে কোথায় থেকে বাংলাদেশে এসেছে?

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময়, অনেক উর্দুভাষী মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল বিহার থেকে আগত, তাই তারা ‘বিহারী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাদের মধ্যে অনেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, সৈয়দপুর এবং অন্যান্য শিল্পনগরীতে বসতি স্থাপন করেন। তারা প্রধানত ব্যবসা, কারিগরি কাজ এবং রেলওয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পার্থক্য থাকায় তারা স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে পারেননি এবং নিজেদের উর্দুভাষী সম্প্রদায় হিসেবে আলাদাভাবে রক্ষা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে বিহারীদের ভূমিকা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিহারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাকিস্তানপন্থী অবস্থান নেয়। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল, যেমন:

  • ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য: উর্দুভাষী হওয়ায় তারা বাঙালিদের থেকে নিজেদের আলাদা মনে করতো।
  • রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ: কেউ কেউ মনে করতো, পাকিস্তান ভেঙে গেলে তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
  • ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা: মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কিছু সহিংসতার ঘটনায় তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানের পক্ষ নেয়।

তবে সকল বিহারীই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন এমন নয়। অনেক বিহারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং বাঙালিদের সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু সংখ্যায় তারা ছিল কম। ফলে স্বাধীনতার পর বিহারীদের বড় অংশ বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে স্থানীয় জনগণের রোষানলে পড়ে।

বিহারীদের ওপর পরিচালিত গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী সময়ে বিহারীদের ওপর বিভিন্ন প্রতিশোধমূলক আক্রমণ হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেক বিহারীকে হত্যা করা হয় এবং তাদের সম্পত্তি লুট করা হয়। বিশেষ করে সৈয়দপুর, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিহারীদের ওপর ব্যাপক সহিংসতা চালানো হয়।

স্বাধীনতার পর, অনেক বিহারী পাকিস্তানে চলে যেতে চাইলেও পাকিস্তান সরকার তাদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তারা বাংলাদেশে আটকা পড়ে যায় এবং শরণার্থী শিবিরে বসবাস করতে বাধ্য হয়। ১৯৭৪ সালের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান কিছু বিহারীকে গ্রহণ করলেও বেশিরভাগই বাংলাদেশেই থেকে যায়।

বিহারীদের উপর পরিচালিত গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ Aisha Ghazi / iResist নির্মিত 71 SLAUGHTERHOUSE ডকুমেন্টারিতে রয়েছে।

বর্তমানে বিহারীদের অবস্থা

বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ২,৫০,০০০ বিহারী বসবাস করেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিলে তারা ভোটাধিকারসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার লাভ করে। তবে এখনো তারা নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেক বিহারী আজও বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছেন এবং নাগরিক জীবনে সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।

বিহারীদের ইতিহাস জটিল এবং সংবেদনশীল। তাদের পাকিস্তানপন্থী অংশ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও, তারা আজ বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। অতীতের বিভেদ ভুলে গিয়ে তাদের সমাজে সমান সুযোগ প্রদান করা মানবিক ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎকে এগিয়ে নেওয়াই সবার জন্য মঙ্গলজনক।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।