ফারাক্কা বাঁধ কেন দেওয়া হয়েছিল? বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপর এর প্রভাব কি?

ভূমিকা

ফারাক্কা বাঁধ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত এই বাঁধ কলকাতা বন্দরের নৌচলাচল বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এর পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক প্রভাব, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপর, ব্যাপক।

ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস এবং উদ্দেশ্য

ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে। নির্মাণ কাজ ১৯৬১ সালে শুরু হয় এবং ১৯৭০ সালে সম্পন্ন হয়, যদিও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল চালু হয় (Farakka Barrage). এটি প্রায় ২,২৪৫ মিটার দীর্ঘ এবং ১০৯টি গেট নিয়ে গঠিত। বাঁধটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার পানি হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে কলকাতা বন্দরের নৌচলাচল বজায় রাখা এবং পলি অপসারণ করা। এছাড়া, এটি ফারাক্কা সুপার থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের জন্য পানি সরবরাহ করে এবং কলকাতা শহরে পানি সরবরাহে সহায়তা করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর, ভারত গঙ্গার পানি ব্যবহারের জন্য বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করে। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান এই পরিকল্পনার সম্ভাব্য ক্ষতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে, কিন্তু ভারত এটিকে প্রাথমিক পর্যায়ের পরিকল্পনা হিসেবে উল্লেখ করে (Banglapedia). ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, এই ইস্যু নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা তীব্র হয়। ১৯৭৪ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ ঘোষণায় পানি ভাগাভাগির বিষয়ে সমঝোতার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালে ভারত একতরফাভাবে বাঁধ চালু করে।

বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপর প্রভাব

বিহার

  • বন্যার সমস্যা: বাঁধের কারণে গঙ্গায় পলি জমা বেড়েছে, যা বিহারে বন্যার সমস্যাকে তীব্র করেছে। এটি নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে পলি জমে নদীর গভীরতা কমে যায় এবং বন্যার ঝুঁকি বাড়ে (Wikipedia).
  • জনগণের ক্ষতি: পলি জমার ফলে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভূমি ধস এবং জমি হ্রাস পাওয়ায় অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ

  • জলবিদ্যুৎ উৎপাদন: বাঁধটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করে, যা পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (Unacademy).
  • কৃষি ও পানি সরবরাহ: এটি কৃষির জন্য সেচের পানি এবং কলকাতা শহরে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
  • পরিবহন ও বন্দর রক্ষণাবেক্ষণ: বাঁধটি কলকাতা বন্দরের নৌচলাচল বজায় রাখতে সহায়তা করে, যা পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশের উপর ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব ব্যাপক। গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে, যা কৃষি এবং মৎস্য সম্পদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, নদীর পানি কমে যাওয়ায় নৌচলাচল ব্যাহত হয়েছে এবং সুন্দরবনের মতো পরিবেশগত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রাও এই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (Bandung Journal).

  • লবণাক্ততা বৃদ্ধি: পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের নদীগুলিতে লবণাক্ততা বেড়েছে, যা কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
  • মৎস্য সম্পদের ক্ষতি: হিলসা মাছের মতো প্রজাতির প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ বাঁধ মাছের অভিবাসন পথে বাধা সৃষ্টি করে।
  • নৌচলাচল ও পরিবেশ: নদীর পানি কমে যাওয়ায় নৌচলাচল ব্যাহত হয়েছে এবং সুন্দরবনের মতো পরিবেশগত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (ResearchGate).
  • ১৯৯৬ সালের চুক্তি: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি ভাগাভাগি চুক্তি এই সমস্যাগুলি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে, তবে এটি সম্পূর্ণ কার্যকর নয় (Testbook).

বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য সমাধান

বাংলাদেশ ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারে:

  1. কূটনৈতিক আলোচনা: ভারতের সাথে ১৯৯৬ সালের চুক্তির ভিত্তিতে ন্যায্য পানি ভাগাভাগি নিশ্চিত করতে ক্রমাগত আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। এই চুক্তি ২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হবে, তাই এটির নবায়ন বা উন্নতি জরুরি।
  2. জল ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন: বাংলাদেশ বিকল্প জল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থায়, যেমন জলাশয়, খাল এবং লবণচ্যুতি কারখানা, বিনিয়োগ করতে পারে, যা গঙ্গার পানির উপর নির্ভরতা কমাতে পারে।
  3. পরিবেশগত পুনরুদ্ধার: ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ প্রচেষ্টায়, পুনরায় বনায়ন এবং জলাভূমি সংরক্ষণের মতো কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে, যা লবণাক্ততা এবং ভাঙন মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে।
  4. প্রযুক্তিগত নবাবিষ্কার: উন্নত সেচ পদ্ধতি এবং শুষ্কতা-প্রতিরোধী ফসল ব্যবহার করে কৃষকদের কম পানিতে সামঞ্জস্য করতে সাহায্য করতে পারে।
  5. আন্তর্জাতিক মাধ্যমস্থতা: নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে জড়িত করে পানি ভাগাভাগি চুক্তির মাধ্যমস্থতা এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারে, যা দুই দে�শের মধ্যে সহযোগিতা এবং বিশ্বাস বাড়াতে পারে।
  6. আইনি পদক্ষেপ: কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা বিবেচনা করা যেতে পারে।
  7. ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: কিছু ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ফারাক্কা বাঁধ বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন, কারণ এটি ভারতের জন্যও ক্ষতিকারক। যদি ভারত এই বাঁধ বাতিল করে, তা বাংলাদেশের জন্যও উপকারী হবে (The Daily Star).
  8. পানি ভাগাভাগি চুক্তি: ১৯৯৬ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ কার্যকর নয়। বাংলাদেশ এই চুক্তি পুনরায় আলোচনা করে ন্যায্য শর্ত নিশ্চিত করতে পারে।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ

নিম্নের সারণীতে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব এবং সমাধানের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:

অঞ্চল

প্রভাব

সমাধান

বিহার পলি জমা, বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি, ভূমি ধস পলি ব্যবস্থাপনা, নদী প্রবাহ উন্নতি
পশ্চিমবঙ্গ জলবিদ্যুৎ, কৃষি, নৌচলাচল সুবিধা বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ, বিকল্প পানি ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশ লবণাক্ততা, মৎস্য সম্পদ ক্ষতি, পরিবেশ ধ্বংস কূটনৈতিক আলোচনা, জলাশয় নির্মাণ, পরিবেশ পুনরুদ্ধার

উপসংহার

ফারাক্কা বাঁধ ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি জটিল এবং সংবেদনশীল ইস্যু। এর প্রভাব বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপর উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপর। বাংলাদেশ এই ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় কূটনৈতিক আলোচনা, জল ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। তবে, এই ইস্যু সমাধানের জন্য দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং বিশ্বাস অপরিহার্য। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের বাঁধ বাতিলের দাবি বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র

ঘটনা

বছর

বিবরণ

প্রভাব

নির্মাণ শুরু ১৯৬১ ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। পাকিস্তান উদ্বেগ প্রকাশ করে।
নির্মাণ সম্পন্ন ১৯৭০ বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়। পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ শুরু।
চালু ১৯৭৫ বাঁধ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। বাংলাদেশে পানি প্রবাহ কমে।
গঙ্গা চুক্তি ১৯৯৬ ভারত-বাংলাদেশ পানি ভাগাভাগি চুক্তি। আংশিক সমাধান, কিন্তু সমস্যা অব্যাহত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।